কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে চলমান অস্থিরতায় বেকায়দায় পড়েছে দেশের সিনেমা হলগুলো। কারফিউর মধ্যে সবকিছুর মতো বন্ধ ছিল সিনেমা হলও। কারফিউ শিথিল হওয়ার পর খুলতে থাকে একক হল ও মাল্টিপ্লেক্স। কিন্তু দর্শক নেই হলে। বাতিল হয়ে যাচ্ছে নতুন সিনেমা মুক্তির পরিকল্পনা। ক্ষতির মুখে প্রযোজক, পরিচালক, হলমালিকসহ সিনেমাসংশ্লিষ্ট সবাই। যা নতুন করে শঙ্কায় ফেলেছে ঢালিউডকে।
ঈদের পাঁচ সপ্তাহে এসেও স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দর্শকদের সিনেমা নিয়ে আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। সপ্তাহান্তে ভিড়ও দেখা গেছে। এর মধ্যে কারফিউ শিথিল হলে শুরু হয় কিছু কিছু সিঙ্গেল সিনেমা হল খোলা। অন্যদিকে কিছুটা সময় নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গত বৃহস্পতিবার থেকে মাল্টিপ্লেক্সগুলো খুলতে থাকে।
স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সর্বশেষ আমাদের সিনেপ্লেক্সে ৪৮টি শো ছিল তুফান সিনেমার। আশায় ছিলাম, এমন চলতে থাকলে পরবর্তী আরেকটা ভালো মানের সিনেমা এলে আমরা চাঙা থাকতে পারব। কিন্তু অস্থির অবস্থার মধ্যে ব্যবসা একেবারেই শেষ বলা যায়। আগে যেখানে ১০০ শতাংশ দর্শক পাওয়া যেত, সেখানে এখন ১০ শতাংশ দর্শকও পাচ্ছি না। আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। পরিস্থিতি একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে; কিন্তু ভালো হলেই কি আগের মতো সেই দর্শক আসবে? আমাদের যেমন ক্ষতি হলো, তেমনি পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি হুমকির মুখে পড়ল।’
জানা যায়, এখন বেলা ১১টা আর ১টায় দুটি শো চালু আছে সিনেপ্লেক্সে। হলমালিকদের কথা, ঈদ ছাড়া বেশির ভাগ সময় সিনেমা চালিয়ে মাস শেষে খরচই ঠিকমতো ওঠে না। সেখানে দুই ঈদের পর আশাবাদী হচ্ছিলেন তাঁরা। কারণ, দীর্ঘ একটা সময় পর দর্শক সিনেমা হলমুখী হচ্ছিলেন। অস্থিরতার আগে যশোরের মণিহার হল তুফান সিনেমা দিয়ে ভালো আয় করে। এখন আয় একেবারেই থেমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক বড় ধাক্কা খেলাম। দর্শক নিয়মিত সিনেমা দেখছিলেন। সেখানে এমন একটা বিরতি হলো যে দর্শকদের হলে আসার ধারাবাহিকতাটাই নষ্ট হয়ে গেল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও মনে হয় না আগের মতো দর্শক ফিরবেন। এর সঙ্গে ভালো সিনেমা লাগবে।’
কেউ কেউ মনে করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে গেলে পরিকল্পনা করে একের পর এক সিনেমা মুক্তি দিতে হবে। প্রচার চালাতে হবে। তাহলে দর্শকশূন্য হল আবার দর্শকে পূর্ণ হবে।
প্রদর্শক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘এবার চলচ্চিত্রের যে ক্ষতি হলো, এটা পোষানোর সক্ষমতা আমাদের নেই। কারণ, এমনিতেই সিনেমা হল নেই। যা বেঁচে ছিল, সেটাও ধুঁকে ধুঁকে চলছিল। যে পরিস্থিতি, তাতে কে শিগগিরই সিনেমা মুক্তি দিতে এগিয়ে আসবে! পরাণ, হাওয়া, সুড়ঙ্গ, প্রিয়তমা, তুফান দিয়ে যে অর্জনটা হয়েছিল, সেটা শেষ হলে গেল। দর্শকশূন্য হলে এখন সরকারের সহযোগিতা দরকার।’
প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে, দেশের এই পরিস্থিতিতে আপাতত নতুন কোনো সিনেমা মুক্তির সম্ভাবনা নেই। গত শুক্রবার মুক্তির তালিকা থেকে সরে গেছে হৈমন্তীর ইতিকথা সিনেমাটি। পরে কবে সিনেমাটি মুক্তি দেবেন, সেটা নিয়েও শঙ্কায় রয়েছেন পরিচালক। অন্যদিকে আগামী শুক্রবার মুক্তির তালিকায় ছিল নন্দিনী। এমন পরিস্থিতির মধ্যে সিনেমা মুক্তি দিতে চান না পরিচালক শোয়াইবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দর্শকদের ভালো একটা স্রোত দেখে ভেবেছিলাম, আগস্টের ২ তারিখে সিনেমাটি মুক্তি দেব। সবই চূড়ান্ত ছিল। এখন এমন অবস্থা যে সিনেমা হলে যাওয়ার মতো দর্শকদের মনমানসিকতা নেই। দর্শক না এলে লগ্নি কীভাবে উঠবে। আমরা ভাবছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগস্টের শেষে মুক্তি দেব। এর মধ্যে শাকিব খানের দরদ কবে মুক্তি পায়, সেটা দেখেই সেপ্টেম্বরের শেষেও মুক্তি দিতে পারি।’
ঈদের পর সর্বশেষ মুক্তি পেয়েছিল আজব কারখানা। সিনেমাটি ১৭ জুলাই পর্যন্ত দর্শক পেলেও পরে সব কটি শো বন্ধ হয়ে যায়। সিনেমার পরিচালক শবনম ফেরদৌসী বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশামতোই দর্শক পাচ্ছিলাম। বুধবারও দর্শক পেয়েছি। এরপর এ পর্যন্ত সিনেমাটির আর স্ক্রিনিং হয়নি। এখন সিনেমা হল পুরোপুরি খোলার অপেক্ষায় রয়েছি। তাহলে হয়তো আবার সিনেমা মুক্তি দিতে পারব।’
ব্যবসায়িকভাবে ঢালিউড বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পোষানো যাবে না বলে মনে করেন প্রযোজক সমিতির সাবেক নেতা খোরশেদ আলম খসরু। তিনি বলেন, ‘সিনেমা হলের ব্যবসার প্রভাব গোটা ঢালিউডে পড়বে। এই যে ভীতিকর একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এর মধ্যে আর যা–ই হোক, সিনেমা দেখার জন্য দর্শকেরা ঘর থেকে বের হবেন না। এখন ভালো সিনেমাও মুক্তি দেওয়ার উপযোগী সময় নয়। সিনেমা চালানোই যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে বিনিয়োগেও প্রভাব পড়বে। তবে দুই ঈদের পর ভালো ভালো সিনেমা যদি হাতে থাকে, সেগুলো পরিকল্পনা করে মুক্তি দিতে হবে। আমাদের ক্ষতি আমাদের পোষাতে হবে।’