কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ‘চলো ভুলে যাই’ গান গেয়ে পরিচিতি পেয়েছেন তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীন। এই ‘জেন–জি’ গায়িকাকে অভিনয়েও দেখা গেছে।
হাতে ইউকুলেলে; কণ্ঠে গান। আর কোনো আড়ম্বর নেই। শ্রোতাদের হৃদয়ে বিষাদ চাগাড় দিয়ে উঠেছে। গানের কথায় দ্রোহও খুঁজে ফিরছেন অনেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে পারশা মাহজাবীনের ‘চলো ভুলে যাই’ গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রকাশের চার দিনের মধ্যে ফেসবুকে ৫০ লাখের বেশিবার গানের ভিডিওটি দেখেছেন দর্শকেরা। ৮ থেকে ৮০—প্রজন্মের ব্যবধান ভুলে পারশাকে শুনছেন শ্রোতারা।
নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গানটি ফেসবুকে শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এটা একদম আলাদা প্রজন্ম। এই প্রজন্মের ক্রমবিকাশ দেখে আমরা গর্বিত। ভালোবাসা ও কুর্ণিশ জানাই।’
নুসরাত ইমরোজ তিশা, মারিয়া নূরসহ অনেকেই গানটি শেয়ার করে পারশার প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছেন।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে যাঁদের জন্ম, তাঁরাই ‘জেন-জি’। পারশাও এই প্রজন্মের গায়িকাদের একজন। পড়াশোনা করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে গানটি লিখেছেন, সুর বেঁধেছেন। খালি গলায় গানটি পরিবেশনও করেছেন তিনি।
১০ মিনিটে লেখা গান
‘কয়েক দিন ধরে চারপাশের অবস্থা দেখে মনের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। মনের চাপা কষ্ট থেকে গানটা লিখেছি।’ গতকাল প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন পারশা মাহজাবীন।
পারশা জানান, কয়েক দিন ধরেই নানা ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল; ফলে সময় বেশি লাগেনি। ১০ মিনিটের মধ্যে ‘চলো ভুলে যাই’ লিখে ফেলেছেন তিনি।
২৮ জুলাই রাত ২টার দিকে গানটা লিখে ইউকুলেলে হাতে নেন। চারবারের চেষ্টায় ভিডিওটা করে রাত আড়াইটার দিকে ফেসবুকে পোস্ট করেন। ঘুম ভেঙে সকালে দেখলেন, লাখো মানুষ গানটা শুনছেন।
‘সকালে উঠে দেখি, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী স্যার গানটা শেয়ার করেছেন। আমি এতটা ভালোবাসা পাব, কখনো প্রত্যাশা করিনি। এত বড় বড় মানুষ গানটা শুনবেন, বাহ্বা দেবেন, কল্পনাও করিনি,’ বলছিলেন পারশা।
পারশা বলেন, ‘ভিউয়ের জন্য নয়, নিজের ভাব প্রকাশের জন্য গানটা করেছি। এত মানুষ গানটা শুনবেন, এত কিছু ভেবেচিন্তে কাজটা করা হয়নি।’
গানটা শুনে ফেসবুকে চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস নামে এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘এত সুন্দর, এত প্রকট সত্য! গানটা শুনে চিৎকার করে কেঁদেছি।’
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (গতকাল বুধবার রাত ৮টা) দেড় লাখের বেশি ‘রিঅ্যাক্ট’ পড়েছে। ৪৪ হাজারের বেশিবার শেয়ার হয়েছে। সাড়ে তিন হাজারের বেশি মন্তব্য জমা পড়েছে।
গানটি কেন এত মানুষের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে? কারণ হিসেবে ঘুরেফিরে গানের কথাকেই তুলে আনছেন অনেকে। পারশাও তেমনটাই বলছেন, ‘গানের প্রতিটি বাক্যের ঘটনার সাক্ষী আমরা। প্রতিটি বাক্যের পেছনে আরও ৫০টা বাক্য মানুষের জানা আছে। ফলে শ্রোতারা সহজেই গানটার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজপথে নামতে চেয়েছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নামতে পারেনি। তাই গানে গানে সহপাঠীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন তিনি। সচরাচর তাঁকে রোমান্টিক গানে শোনা গেছে; তবে এবারই প্রথম কোনো প্রতিবাদের গানে দেখা গেল।
গানটিকে কপিরাইটমুক্ত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এই গায়িকা ফেসবুকে লিখেছেন, চাইলে যে কেউ গানটা কাভার করতে পারেন।
পারশার চাওয়া, ‘আমি চাই, আমার বাংলা মা আবার সুস্থ হয়ে ফিরুক। যে দেশের মাটিতে বসে আমি শব্দচয়ন শিখেছি, গাইতে শিখেছি, এভাবে লিখতে শিখেছি, সেই দেশ ভালো থাকুক। এই দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমি চাই আমার দেশের মানুষ ভালো থাকুক, আর কোনো মায়ের কোল খালি না হোক। আমি চাই সব সহিংসতার বিচার হোক, আমার ভাইবোনদের রক্তের দাম দেওয়া হোক।’
গানের পারশা
পারশা মাহজাবীনের পৈতৃক নিবাস দিনাজপুরে। তবে বাবার চাকরির সূত্রে জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বগুড়ায়। মায়ের কণ্ঠে গান শিখেছেন। বছর তিনেক ধরে বগুড়ার গানের শিক্ষক আবদুল আউয়ালের উচ্চারণ একাডেমিতে (পরবর্তীকালে চর্চা সাংস্কৃতিক একাডেমি) গান শিখেছেন।
উচ্চাঙ্গসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লোকসংগীতসহ নানা ধরনের গানের চর্চা করেছেন পারশা। ২০১৯ সালে ইউটিউবে চ্যানেল খুলে গান কাভার করতে শুরু করেন।
২০২১ সালে রাফাত মজুমদারের লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন নাটকের দ্বৈত গান ‘দুজন হেরে যাই’–এ কণ্ঠ দেন পারশা। তিন বছরের ক্যারিয়ারে ‘কপি পেস্ট’, ‘পুতুলের সংসার’, ‘যে প্রেম এসেছিল’সহ বেশ কয়েকটি নাটকে গেয়েছেন তিনি।
নাটকের গান বেশি করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘নাটকে মেলোডি গান বেশি হয়; সে কারণেই বোধ হয় নাটকে গানের প্রস্তাব বেশি পাই। তবে সিনেমার গানও করার আগ্রহ রয়েছে।’
গত বছর বলিউডের গায়ক দার্শান রাভাল ও ঢাকার গায়ক তানভীর ইভানের সঙ্গে মঞ্চে দেখা গেছে পারশাকে। বগুড়ায় প্রীতম হাসানের সঙ্গে একটি শোয়েও গেয়েছেন তিনি।
পারশার প্রিয় শিল্পীদের তালিকায় শ্রেয়া ঘোষাল, রুনা লায়লা, এড শিরানসহ আরও কয়েকজন রয়েছেন।
বলিউডে গাওয়ার স্বপ্ন দেখেন পারশা।
অভিনয়েও আছেন
গানের পাশাপাশি টুকটাক অভিনয়ও করছেন পারশা মাহজাবীন। এ বছর ভালোবাসা দিবসে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রবীর রায় চৌধুরীর নাটক লাভ লাইন দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক ঘটেছে তাঁর। এতে জোভান ও নীহার সঙ্গে মূল চরিত্রে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।
গত মে মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত মাহমুদুর রহমানের প্রথম ভালোবাসা নাটকেও অভিনয় করেছেন পারশা মাহজাবীন। গান ও অভিনয়ের মধ্যে গানটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চান তিনি। তবে অভিনয়টাও চালিয়ে যেতে চান।
পারশা বলেন, ‘অভিনয়ে অনেক প্রস্তাব আসছে, তবে আগে গানের কাজগুলো সেরে নিতে চাই। আমার কাছে গানই আগে। আর অভিনয় শেখার দরকার আছে। অভিনয় নিয়মিত করা হবে না, তবে টুকটাক করব।’