বাংলাদেশের মানুষ, ছাত্র-জনতা এখন বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে জানে। সব ভয়কে উপেক্ষা করে সব কর্তৃত্ববাদকে অকার্যকর করে দিয়ে আজকে নতুন করে আমাদের স্বাধীন হওয়ার পথ সুগম হচ্ছে, সেখানে ছাত্ররাই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটি শুরু করেছিল। এখন শুধু ছাত্ররা না, যাঁদের সন্তান প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে, তাঁদের সবাই আজকে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ন্যক্কারজনক হামলা এবং কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রতিবাদী সমাবেশে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
রায়হান রাইন বলেন, ‘বর্তমান সময়ে যে পরিস্থিতি, সেই পরিস্থিতিতে আমাদের একটি উপলব্ধি খুবই স্পষ্ট বর্তমান সরকার এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ত্রাস ও ভয়ের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশের মানুষ ছাত্র-জনতা সেই ভয়কে জয় করেছে। সবাই আজ জেগে উঠেছে, ভয়–সন্ত্রাসকে জয় করে এই গণ–অভ্যুত্থান নিশ্চয়ই জুলুমবাজ সরকারের পতন ঘটাবে।’
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরাও যোগ দেন। এ ছাড়া সংহতি জানিয়ে কর্মসূচিতে সাভারের বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরাও অংশ নেন। পরে সেখান থেকে প্রতিবাদী গানের মিছিল বের করেন তাঁরা। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে পুরোনো ফজিলাতুন্নেসা হলসংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহতদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। পরে সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরপর সেখান থেকে পুনরায় মিছিলটি একই পথে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া একই স্থানে পারফরম্যান্স আর্ট পরিবেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক আরিফ সোহেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী লিয়নসহ গ্রেপ্তার সব শিক্ষার্থীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া বক্তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ন্যক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে সমাবেশে পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আপনি এখনো মিথ্যা বলছেন। আমাদের ছাত্ররা যে পথ দেখিয়ে গেছে, আমরা শিক্ষকেরা সেই পথে হাঁটব, আপামর জনতা হাঁটবে। আমরা মনে করি, আমরা যে রাষ্ট্র নির্মাণে করতে চাই, আপনি সেই পথে বাধা হিসেবে উপনীত হয়েছেন। আগামীতে যদি এভাবে আন্দোলনকারীদের জেলে নিতে থাকেন, তাহলে আমরা স্বেচ্ছায় কারাবরণ করব।’
দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, ‘পুরো বাংলাদেশ আজ শিক্ষাঙ্গন। সবাই সরকারের চাল বুঝে গিয়েছে ‘দিনে নাটক, রাতে আটক’ খেলা খেলছে তারা। জাবির যে দুই শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে আমরা তাদের মুক্তি চাই।’
বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাহিদ কায়সার বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীরা তাদের কিছু দাবি নিয়ে পথে নেমেছিল। সংগত বা অসংগত দাবি যা–ই হোক, তাদের দাবিগুলো শোনার সময় দেওয়া উচিত ছিল। আমি একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক হিসেবে এই আন্দোলনে সংহতি জানাতে এসেছি। আমি চাই শিক্ষার্থীরা ন্যায়বিচার পাক, যারা হত্যাকারী, তাদের বিচার হোক।’
সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম বলেন, ‘আন্দোলনের শুরুতে আমরা দেখলাম ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার জন্য ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের বললেন রাজাকার। প্রধানমন্ত্রী, ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিলেন আবার তাঁরাই নাকি কান্না শুরু করেছেন।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক আবদুর রশিদ বলেন, ‘যৌক্তিক ও নায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষিকাকে পুলিশ লাঞ্ছিত করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বাসভবনে বোমা হামলা হয়েছে। বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবিবের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মো. শওকত হোসেন, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদা পারভীন এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী শরণ এহসান প্রমুখ।