রাখাইন পরিস্থিতি।
টেকনাফ সীমান্তে গুলির শব্দ, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা।

- আপডেট সময় : ০২:১০:১৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫ ১৩ বার পড়া হয়েছে
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাখাইন রাজ্যের দখলদার সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় ওইসব এলাকার রোহিঙ্গারা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকে নৌকায় নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গতকাল শুক্রবার রাত ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদীর ওপারে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি গ্রামে গোলাগুলি শুরু হয়। থেমে থেমে সেই গোলাগুলি আজ শনিবার ভোর পাঁচটা পর্যন্ত চলতে থাকে। ওপারের গুলির শব্দ এপারের (হোয়াইক্যং) লোকজন শুনতে পেয়েছেন।
এর আগে ১৯ আগস্ট রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যের ‘নারকেল বাগিচা’ এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আরাকান আর্মির দখলে থাকা দুটি সীমান্তচৌকির দখলে নিতে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এ হামলা চালায় বলে জানা গেছে। তার ১০ দিন আগেও একই এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল।
শুক্রবার রাতে ওপারের গুলির শব্দ শুনতে পান টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরীও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার রাত ১০টা থেকে শনিবার ভোররাত ৫টা পর্যন্ত টানা ৭ ঘণ্টা সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চলেছে। তাতে নাফ নদীতে মাছ শিকারে নামা বাংলাদেশি জেলে ও হোয়াইক্যং সীমান্ত জনপদের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে ওপারের গুলি এপারে এসে পড়েনি। নাফ নদীতে বিজিবির টহল রয়েছে।
সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ২০২৪ সালে টানা ১১ মাস হোয়াইক্যং সীমান্তের মানুষ ওপারের মর্টারশেলের বিকট শব্দ শুনেছেন। এরপর টানা সাত-আট মাস এপারের মানুষ গোলার শব্দ শুনতে পাননি। কিন্তু হঠাৎ করে গতকাল রাতে ওপারের গোলাগুলির শব্দে টেকনাফের বাসিন্দাদের ঘুম ভেঙে যায়, অনেকে হতচকিত হয়ে পড়েন।
হোয়াইক্ষ্যং সীমান্তের বেড়িবাঁধের কাছাকাছি বাংলাদেশিদের বেশ কয়েকটি চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের ঘের রয়েছে। একটি চিংড়িঘেরে থাকেন হোয়াইক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা ও চিংড়ি ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান। ঘেরের পূর্বপাশে নাফ নদী, তারপর রাখাইন রাজ্য। রাতভর গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বিগ্ন মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বিপরীতে রাখাইন রাজ্যের কুমিরখালী, শীলখালী ও সাইডংসহ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে। আট বছর আগেও এসব গ্রামে রোহিঙ্গা বসতি ছিল। মিয়ানমার জান্তা বাহিনী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে লাখো রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। এরপর সেখানে গড়ে তোলা হয় সেনা ব্যারাক ও সীমান্তরক্ষীদের চৌকি। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর জান্তা বাহিনীকে উচ্ছেদ করে সেনা ছাউনি ও ব্যারাকগুরো দখলে নেয় আরাকান আর্মি। এখন আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে নতুন করে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ (আরআইআর) কয়েকটি গোষ্ঠী। তাতে বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মংডুটাউনশিপের কাছাকাছি নাফ নদীর তীরে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। নাফ নদী অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা টেকনাফ অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটকও হচ্ছে।
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার টেকনাফ বিজিবি নাফ নদীতে ৬২ জন রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করেছে জানিয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওপারে হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও স্থলসীমান্তে বিজিবি তৎপর রয়েছে।
বিজিবির অধিনায়ক বলেন, ‘কিছু লোক সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। যেসব পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চলছে, সেখানে বিজিবির টহল বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
রাখাইন রাজ্যে গোলাগুলির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সীমান্তে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। পাশাপাশি অনুপ্রবেশ ঠেকাতে স্থল-জলপথে বিজিবি-কোস্টগার্ড শক্ত অবস্থানে রয়েছে।’
বিজিবি ও পুলিশ জানায়, ১১ আগস্ট আরাকান আর্মির একজন সদস্য একটি একে-৪৭ রাইফেল ও ৫২ রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগাজিন নিয়ে বাংলাদেশের উখিয়ায় পালিয়ে এসে বিজিবি সদস্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর নাম জীবন তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি বিজিবির হেফাজতে আছেন। জীবন তঞ্চঙ্গ্যা নিজেকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন। ১৭ আগস্ট দুপুরে বিজিবি সদস্যরা তুমব্রু সীমান্ত থেকে আরকান আর্মির সহযোগী আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসরুল হক বলেন, এ পর্যন্ত বিজিবি পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশে হস্তান্তর করেছে। তাদের মধ্যে তিনজন মিয়ানমারের নাগরিক, দুজন বাংলাদেশি। সবাই বান্দরবান কারাগারে রয়েছেন।