সমাচার ডেস্ক
বারবার ঠিকানা বদলাচ্ছেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। সূত্রমতে বর্তমানে তিনি এখন তুরস্কে। ৬ জুনের আগে দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাই দুদকের তলবে তার হাজিরা নিয়ে রয়েছে সংশয়। এদিকে বেনজীরের সম্পদের নতুন নতুন তথ্য বেড়িয়ে আসছে প্রতিদিনই। বান্দরবানে মিলেছে বেনজীরের আরো ১০০ একর জমির সন্ধান। যেখানে গরুর খামার ও মাছের চাষ করতেন তিনি।
আরব্য রজনীর গল্পেও এতোটা রহস্য ছিলো না। গত কদিন যতোটা রহস্যময় হয়ে দেখা দিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অবস্থান। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এই তথ্য প্রায় নিশ্চিত। কেউ বলছেন দুবাই, কারো মতে তিনি সিঙ্গাপুর। নতুন করে বাজারে চাউর হয়েছে এক সময় শিনা টান করে চলা বেনজীরের এখন নতুন আস্তানা তুরস্কে।
একাধিক আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তথ্য বলছেন, তুরস্কের যে বাসায় অবস্থান করছেন বেনজীর তা তার পুরোনো বন্ধুর। যিনি পুলিশের ঠিকাদারি কাজ করতেন আইজিপি থাকা অবস্থায়। তবে তার অবস্থান নিয়ে কোনো তথ্যই নেই তার আইনজীবীর কাছে। এতোকিছুর মাঝে যেই প্রশ্নটি সাধারণের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে, ৬ জুন কী দুদকে হাজির হচ্ছেন বেনজীর আহমেদ? সূত্র বলছেন, ৬ জুনের আগে বেনজীরের দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। আইনজীবীর মাধ্যমে সময় আবেদন করতে পারেন দুদকে।
দুদক আইনজীবী বলছেন, গত ছয় মাসে ব্যাংক একাউন্ট থেকে কত টাকা তুলে নিয়েছেন বেনজীর সে বিষয় খোঁজ চলছে।
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আমি মনে করি যেহেতু বিষয়টি এখন দুদকের অনুসন্ধান চলছে। সবচেয়ে ভোলো হয় ভুক্তভোগী দুদকে দরখাস্ত দিলে। এছাড়া কারো থেকে যদি টাকা নিয়ে থাকে তাহলে টাকা উদ্ধারের জন্য তো অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে, সিভিল মামলা করতে হবে। অ্যাকাউন্ডগুলোর ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
সন্ধান মিলেছে আরো ১০০ একর জমির
বেনজীরের সম্পদের নতুন নতুন তথ্য বেড়িয়ে আসছে প্রতিদিনই। নতুন করে বান্দরবানের পাহাড়ে সন্ধান মিলেছে ১০০ একর জমির। বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়া। এখানে দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করতেন আবুল কাশেম ও তার পরিবার। প্রায় ৫৫ একর জায়গা ছিলো তাদের দখলে। তবে তারাও লিজের নামে দখল করে রেখেছিলেন পুরো জমি। বছর পাঁচেক আগে বান্দরবান সফর করেন পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তান। ওই জমিটি তাদের পছন্দ হলে নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু আবুল কাশেম ও তার পরিবার জায়গাটি দিতে অস্বীকৃতি জানালে পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে নামকাওয়াস্তে অর্থে নেওয়া হয় পুরো জমিটি। গড়ে তোলেন গরুর খামার ও রিসোর্ট আকারের কয়েকটি ঘর। এগুলো আবার দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা ও কয়েকজন পুলিশকে।
বান্দরবানের মতোই রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বেনজীর আহমেদের সন্ধান মিলেছে অন্তত ২০ একর জায়গা। ওইসব জায়গায় তিনি রিসোর্ট ও খামার করার পরিকল্পনা করেছিলেন। জেলা পুলিশের কিছু সদস্য তাকে সহায়তা করলেও সিনিয়র অফিসারদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিলো। আর র্যাব মহাপরিচালক ও পুলিশ প্রধান থাকাকালে তিনি এসব কর্মকাণ্ড করেছেন। ইতিমধ্যে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন নতুন জায়গার সন্ধান পাচ্ছে।
কোটিপতি হয়েছেন বেনজীরের শ্বশুরবাড়ির লোকজনও
বেনজীর আহমেদকে পুঁজি করে কোটিপতি হয়েছেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও। তাদের বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সংশ্লিষ্টরা জানায়, দুদকের তালিকার বাইরেও বেনজীর আহমেদের আরো সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরও দুর্নীতির তথ্য আসছে। সাবেক পুলিশ প্রধানের এখন এমন সব স্থানে সম্পত্তি পাওয়া যাচ্ছে, তা সব দুর্নীতিকে হার মানছে। তার সম্পদের পরিমাণ দেখে পুলিশ কর্মকর্তারাও হতবাক হয়ে পড়ছেন।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, দায়িত্বে থাকাকালে বেনজীর আহমেদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বক্তৃতায় প্রায়ই বলতেন পুলিশের কোনো সদস্য দুর্নীতি বা কোনো ধরনের অপরাধ করলে তার দায়ভার বাহিনী নেবে না। এখন তিনি যে ধরনের অপরাধ করেছেন তার দায়ভার কে নেবে? তবে তার দুর্নীতির বিষয়টি তাকেই বহন করতে হবে। পুলিশে প্রতিটি সদস্য লজ্জিত বিষয়টি নিয়ে। ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, তিনি (বেনজীর) ৪ মে সপরিবারে সিঙ্গাপুরে গেছেন তা সত্য। দুই দিন আগে তিনি তুরস্ক গেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। গোপালগঞ্জ ও তার শ্বশুরবাড়ির দুই ব্যক্তি তুরস্কে আছেন। তারা একসময় পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাব সদর দপ্তরে ঠিকাদারির কাজ করতেন। তারা বেনজীর আহমেদকে ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন হলে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। তাদের বক্তব্য শুনতে হয়। সে কারণেই বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাদের নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে বক্তব্য না দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে অন্তত দেড়শ একর জায়গার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগের ৩ নম্বর সিটে ২৫ একর লিজের জমি ক্রয় করেন বেনজীর। সেখানে মাছের প্রজেক্ট, গরুর খামার, ফলের বাগান ও রিসোর্টের কয়েকটি কক্ষ আছে। এর মধ্যে গরুর খামারে ৩৩টি গরু আছে। এবারের কোরবানির ঈদে গরুগুলো বিক্রি করার কথা ছিলো। ওই জায়গার বর্তমান বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা ও কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের আর দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাছাড়া লামা উপজেলার সরই ডলুছড়ি মৌজার টংগো ঝিরিতে রয়েছে আরো অর্ধশত একরেরও বেশি জায়গা। তথ্য পেয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল ওই স্থান পরিদর্শন করেছেন।
ওই টিমের এক সদস্য জানান, সুয়ালকের মাঝেরপাড়ার চা অফিস থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরে ২৫ একর জমি জুড়ে রয়েছে ‘নেচার হিল এগ্রো’ নামে গরু-মৎস্য খামার, সেগুনসহ বিভিন্ন ফল ও ফুলের বাগান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোতলা পাকা দালান। খামারটিতে কাজ করছেন ১০ জনের মতো শ্রমিক।
অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়। তাছাড়া জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে। ইতিমধ্যে সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন বেনজীর আহমেদ। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিলো। ওই সময় আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।