এ যেনো নতুন এক বাংলাদেশ দেখছে বিশ্ববাসী। যে বাংলাদেশে এক সময় ত্রাণ নেয়ার প্রতিযোগিতা চলেছে সেই দেশেই এখন ত্রাণ দেয়ার হিড়িক। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী পরিবারের চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে সেই পরিবার আরেক পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁচ্ছে দিতে সাহায্য করছে। এমন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এবং সম্প্রীতির দৃশ্য আগে কখনও দেখেনি বাংলাদেশ।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্রের সংস্কারে ব্যস্ত ঠিক সে সময় দেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সরকার যখন এই পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাওয়ার কথা ছিল ঠিক এমন সময়ই গোটা দেশের মানুষ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগিয়ে আসে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন।
একদিকে যেমন ঢাকা বা সারা দেশ থেকে মানুষ সাহায্য নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে; সেখানকার মানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে উদারতা, ধৈর্য এবং আতিথেয়তা। যিনি ত্রাণ পাচ্ছেন তিনি সামনে এগিয়ে দিচ্ছেন, যিনি ত্রাণ পাচ্ছেন না তার কাছে।
ঢাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে আস এমনি এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যোগ দেয় সময় সংবাদ; সেখানকার সার্বিক অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য। অন্যান্য এলাকার মতো নোয়াখালীর কবিরহাটের নেওয়াজপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এখন পানিবন্দি। বাসা বাড়ি সব কিছুই পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এমনটি পানির চাহিদা মেটাবে যে টিউবওয়েল সেই টিউবওয়েলও এখন পানির নিচে।
এ অসহায় দৃশ্যের মাঝেও যেন নিজেদের মনোবল শক্ত করে রেখেছেন সে এলাকার বাসিন্দারা। শক্ত মনে এই বন্যার কাছে হার না মানার শপথ নিয়েছেন তারা। বন্যার এমন পরিস্থিতেও তাদের মধ্যে উদারতা চোখে পড়ার মতো। কেউ ত্রাণ পেলে তিনি তার প্রতিবেশীর কাছে ত্রাণ দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। নিজে না নিয়ে অন্যকে দেয়ার জন্য তার বাড়ি চিনিয়ে দিচ্ছেন।
৮ নং ওয়ার্ডে করিম সাহেব। তার পুরো বাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। তবে তিনি ত্রাণ পেয়েছেন। তার কাছে যখন স্বেচ্ছাসেবী দল ত্রাণ নিয়ে যায়, সাথে সাথে তিনি একটু ভেতরে তার প্রতিবেশীর বাড়ি চিনিয়ে দেন যেন সেখানে ত্রাণ পৌঁছায়।
তিনি বলেন,
—আমি ত্রাণ পেয়েছি। আমার পরিবারের সদস্য ৩ জন। আমাদের কাছে যা আছে আমরা তা দিয়ে আল্লাহর রহমতে চলতে পারব। কিন্তু একটু ভেতরে অনেক মানুষ রয়েছেন যারা এখনও ত্রাণ পাননি। পারলে তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেন।
ঢাকা থেকে যারা আসছেন তাদের অধিকাংশই যাদের বাড়ি সামনে তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু যাদের বাড়ি একটু ভেতরে তাদের অনেকের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। তাই এবার একটু ভেতরে যাওয়ার পালা। সেখানে দেখা গেল অসংখ্যা মানুষ সেখানে পানিবন্দি কিন্তু সাহায্য খুব একটা পৌঁছাচ্ছে না। তাদের অনেকেরই দাবি, ভেতরের দিকে সাহায্য তেমন একটা আসে না। অসহায় অবস্থা সেখানেও তবু সেখানের মানুষদের উদারতা মুগ্ধ করার মতো।
যেখানে বড় নৌকা দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না সেখানে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার জন্য তারাই এগিয়ে আসছেন। সেখানে ত্রাণ নিয়ে কোনো কাড়াকাড়ি নেই। আগে পাওয়া এবং বেশি নেয়ার কোনো হুড়োহুড়িও নেই। সেখানে শুধুই অসহায়দের কাছে পর্যান্ত খাবার পৌঁছে দেয়ার লড়াইটাই লক্ষ্য করা গেছে।
অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে ১১টি জেলার অন্তত অর্ধকোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এসব এলাকায় বন্যায় ক্ষত এখনো শুকায়নি।
বন্যাদুর্গত ১১ জেলায় এরইমধ্যে ৭১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী রেজা গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, বন্যায় ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২। এখনো পানিবন্দি আছে ৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫টি পরিবার। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৪৫ জন। এছাড়া ১৯ শিশু ও সাতজন নারী রয়েছেন।
জেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, ফেনীতে মারা গেছে সবচেয়ে বেশি, ২৮ জন। এরপর কুমিল্লায় ১৯, চট্টগ্রামে ছয়, নোয়াখালীতে ১১, কক্সবাজারে তিন এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, লক্ষ্মীপুর ও মৌলভীবাজারে একজন করে।