সমাচার ডেস্ক
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দেশজুড়ে সার্বিক সংকট আরো গভীর হয়েছে উল্লেখ করে তা নিরসন না হলে ‘সরকারের ভবিষ্যৎ খুব ভালো নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, বর্তমান সরকার মনে করছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের সব সংকট উতরে গেছে। বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সরকার সংকট উতরে যায়নি। আজ রোববার (১২ মে) দুপুর ১টায় রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ওনাদের (সরকার) একটা ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে যে, ওনারা সংকট কাটিয়ে উঠেছেন। আসলে সংকট আরো গভীর করেছেন। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংকট আরো গভীর হয়েছে।’ ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ওনারা যদি এখনো সেটা উপলব্ধি না করেন, ভবিষ্যৎ তাদের জন্য খুব ভালো নয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখানে একটা গোত্র তৈরি করা হচ্ছে, যাদের সমস্ত রকম দুর্নীতি-অনিয়মের মধ্য দিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। একটা লুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সেটা দিয়ে তারা এই সরকারকে টিকিয়ে রাখছে। এর মধ্যে তারা নিজেরাও জড়িত এবং তাদের সুবিধাভোগী লোকজনও জড়িত।
ফখরুল বলেন, আজকে যেগুলো দেখছেন, সেগুলো হচ্ছে লুট…. মেগালুট। একজন ব্যক্তি সে এখন সিঙ্গাপুরে গিয়ে হাইয়েস্ট ইনভেস্টর… চার নম্বরে আছেন… তাই না। আর কয়েকজন ব্যক্তি আছেন পানামা লিস্টের মধ্যে পড়ে যায়। এত টাকা তারা বানিয়েছেন। এরা দুর্নীতি-অনিয়মের ওপর ভিত্তি করে এই রাষ্ট্রকে কী করে পরনির্ভরশীল করা যায় এবং তাদের বিশেষ গোত্রকে কিভাবে অন্যায়ভাবে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী করা যায়, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ করছে।
তিনি বলেন, কারো কোনো জবাবদিহিতা নাই তো, কারো কোনো স্ট্যাক নাই তো। এখানে দেখেন, একজন মন্ত্রীর, যার লন্ডনে বাড়ি পাওয়া যায় তিন শ-আড়াই শটির মতো, পত্রিকায় দেখা যায় যে, মন্ত্রী-এমপির বাড়ি-সম্পদ দেশের বাইরে রয়েছে… কারো কোনো স্ট্যাক নেই এখানে। তারা ডোন্ট কেয়ার। তাদের যে বক্তব্য, দাম্ভিকতা- এটা অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে… এমনভাবে কথা বলেন যে, ওনারা ছাড়া দেশে আর কেউ নাই। তিনি আরো বলেন, এটাতেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র অলরেডি হয়েই গেছে। আমরা সেটা আগের থেকে বলে আছি যে এই সরকার পরিকল্পিতভাবে এই রাষ্ট্রের এই পরিণতি তৈরি করেছে। কখন ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়? যখন অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে, যখন তার রাজনৈতিক স্ট্রাকচারটা ভেঙে ফেলে, সামাজিক কাঠামো ভেঙে যায়, যখন কোথাও জবাবদিহিতা থাকে না, তখন রাষ্ট্র একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়… নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এখন গোটা দেশে একটা নৈরাজ্য চলছে।
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তির পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব বলেন, জিয়াউর রহমান একটা ক্লোজড ইকোনমি, একটা ফেল্ড পলিটিক্যাল স্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে এসে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়েছিলেন, মিক্সড অর্থনীতি এবং পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট সেক্টর চালু করেছিলেন। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। খালেদা জিয়া তার শাসনমালে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে গেছে। একটা বিষয় আপনাদের মনে থাকার কথা-২০০৬ সালের সময়ে নিউজ উইকের মতো পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছিলো, বাংলাদেশ ইমার্জিং টাইগার…।
সরকারি হাসপাতালের অবস্থা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনারা কি সরকারি হাসপাতালে কেউ গেছেন? যদি যান বিশেষ করে ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালে যান অবিশ্বাস্য… হাসপাতালে ঢোকা যায় না এত দুর্গন্ধ, এত নোংরা, দালালদের অত্যাচার- চিন্তা করা যায় না। আর হাসপাতালের চারপাশে নতুন নতুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে…এটা বড় ব্যবসা। এখান থেকে দালালরা আসে, সরকারি হাসপাতাল থেকে ধরে নিয়ে যায় রোগী… এই হচ্ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনের আগে বহু নেতাকর্মীকে একতরফা সাজা দিয়েছেন আদালত। এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছে বিএনপি। বিনা শুনানিতেও সাজা দিয়েছে সরকার। এখনো গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে রয়েছেন।
নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরাজনীতিকরণ করতে দুই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ত্ব যেন না থাকে। মানুষের সর্বশেষ আশা ভরসার স্থল হচ্ছে কোর্ট, কিন্তু সেখানেও এখন আর কেউ কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না।
৫২৭টি ভারতীয় পণ্যে বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রতিটি দেশেরই উচিত, নিজ নিজ দেশে আমদানি পণ্য পৌঁছার পর পণ্যের মান পরীক্ষা করা। আমদানি করা পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানো মাত্রই জনগণের ক্রয়ের জন্য বাজারে পাঠিয়ে দেয়া উচিত নয়। কারণ, এর আগেও ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ১২১টি ভারতীয় পণ্য মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। তারপরও পণ্যের উৎস দেশটি এই পণ্যগুলো ত্রুটিমুক্ত করার জন্য জন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, হংকং এবং সিঙ্গাপুর তাদের দেশে ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচ ও এভারেস্ট স্পাইসের গুঁড়া মসলা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সিঙ্গাপুরও দেশটির বাজার থেকে এভারেস্টের গুঁড়া মসলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে। হংকং ভারতীয় দুই কোম্পানির গুঁড়া মসলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ইথিলিন অক্সাইড শনাক্ত হওয়ার পর দেশ দুটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সভা মনে করে, জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশেরও উচিত দেশে আমদানি করা প্রতিটি পণ্য বাজারে ছাড়ার আগে যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পণ্যের মান যাচাই করা। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য বাজারে ছাড়া উচিত নয়।
বিশ্ব মা দিবসের দিন গণতন্ত্রের নেত্রী খালেদা জিয়া কেমন আছেন, জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির মা নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মা। এ জন্য যে, এই মহীয়সী নেত্রী তিনি সারা জীবন এই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের এই মহীয়সী নেত্রীর তাঁর সঠিক মূল্যায়নটা এ দেশের অনেকে করতে পারছেন না। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়া এখন লড়াই করছেন তার জীবনের। তার স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনারা দেখছেন যে, প্রায়শ তিনি যাচ্ছেন হাসপাতালে, তিনি চেকআপ, প্রসিডিউরও হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে, আবার বাসায় ফিরে আসছেন…. আসার পরেও কিন্তু তিনি ২৪ ঘণ্টাই বলা যায় যে তিনি মেডিক্যাল কেয়ারের মধ্যে আছেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দলীয়করণে উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে কারণে ব্রেনড্রেইন হয়ে যাচ্ছে… যারা মেধাবী, যারা নিজের যোগ্যতা আছে, তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সচিব ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফর প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির মহাসচিব বলেন, দেখুন এসব আমাদের জিজ্ঞাসা না করে ওনাদের (আওয়ামী লীগ সরকার) জিজ্ঞাসা করুন। এসব নিয়ে আমরা ইন্টারেস্টেড না। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগণের ওপরই আমাদের ভরসা, আমাদের পুরো আস্থা, সেই আস্থার ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। রাজনীতিও আমাদের জনগণকে নিয়ে।