১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বেলা পৌনে তিনটার কথা। ভাত খেতে বসেছিলেন ইমন। বাবা বসে ছিলেন তাঁর পাশেই। দুই নলা ভাত মুখে দেওয়ার পরই মুঠোফোনে একটা কল আসে, এক গ্লাস পানি খেয়ে খাবার ফেলেই উঠে যান ইমন। ‘কই যাছ রে বাবা’—মায়ের এমন প্রশ্নে ইমনের জবাব ছিল, ‘খেলাত যাই।’ এভাবে খাবার ফেলে না উঠতে বাবা ধমক দেন তাঁকে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালে পড়ে থাকার খবর পায় পরিবার।
নরসিংদীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে প্রথম যে দুজন নিহত হন, তাঁদের মধ্যে মো. ইমন মিয়া (২২) একজন। পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের দড়িচর এলাকার বর্গাচাষি কাইয়ুম মিয়া ও মর্জিনা বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। নরসিংদী আইডিয়াল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ইমন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ইমনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা মর্জিনা বেগম অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছেন। পরিবারের সদস্যরা বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমনের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে মর্জিনা বেগম শয্যাশায়ী। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে ইমন সবার ছোট। ৫ শতাংশ বসতবাড়ির ভিটা ছাড়া পরিবারটির আর কিছু নেই। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে না পারা তাঁর বড় ভাই ইয়ামিন মিয়া (২৫) দুই বছর আগে ধারদেনা করে সৌদি আরবে গেছেন। কয়েক মাস ধরে তিনি কিছু টাকা পাঠাতে শুরু করেছেন। বোন ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মাধবদীতে। বাড়িটিতে থাকতেন মা, বাবা আর ইমন। কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ইমনকে নিয়ে স্বপ্ন বুনছিলেন তাঁরা।
ইমনের মা মর্জিনা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই দিন দুপুরে ইমন আমারে কইল, “খিদা লাগছে, ভাত দেও।” তারে ভাত-তরকারি দিয়া ডাইল আনতে গেছিলাম। তাঁর বাবা একটু আগে ভাত খাইয়া খাটের উপ্রে বইসা আছিল। কে জানি ফোনে হেরে কী কইছে, খাওন থুইয়াই হে উইঠা যায়। কই যাছ রে বাবা জিগাইলে উত্তর দেয় খেলাত যাই। পাতের খাওন থুইয়া উইঠা যাওয়ায় বাপে তারে একটা ধমকও দিছিল। কথা শুনে নাই, দৌড়াইয়া চইলা যায়। হুদা দুই নলা ভাত মুখে দিছিল হে।’
একটি ভাঙাচোরা ছোট টিনের ঘর দেখিয়ে মর্জিনা বেগম বলছিলেন, ‘ঘরটার মইধ্যে সারাডা দিন বইয়া বইয়া পড়ত। কলেজে যাওয়া, পড়ালেহা ছাড়া আর কিছুই করত না। বন্ধুগর লগে তারে আড্ডা দিতেও দেখা যাইত না। ওই দিন মরণ তারে হেন ডাইক্কা লইয়া গেছিল।’
১৮ জুলাই নরসিংদী শহরের ভেলানগর এলাকার জেলখানার মোড়ে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন ইমন মিয়া। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেলা তিনটা থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে স্লোগান দিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেদিন পুলিশ সদস্যরা কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছুড়ছিলেন আর আন্দোলনকারীরা ছুড়ছিলেন ইটপাটকেল। সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত আড়াই শতাধিক আন্দোলনকারী দুই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক ইমন মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মাহমুদুল কবির বাসার প্রথম আলোকে জানান, মৃত অবস্থায় অজ্ঞাত ওই তরুণকে (ইমন) নরসিংদী সদর হাসপাতালে আনা হয়। ছররা গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠাতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থী ও তাঁর স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ নিয়ে চলে যান।
ইমনের বড় বোন ইয়াসমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনই ইমন পুলিশের গুলিতে মারা গেল। বিকেলে তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসার পর স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজার পর রাতে দাফন করা হয়। ইমনের মৃত্যুর দিন থেকেই মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছেন, বাবাও ভেঙে পড়েছেন।’
সেদিন ভাতের থালা থেকে উঠে যাওয়ার ৩০ মিনিট পরই ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার কথা জানিয়ে কাইয়ুম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনে যাওয়ার কথা বললে ছেলেরে কোনোভাবেই যেতে দিতাম না। ঘর থেকে বের হওয়ার প্রায় ৩০ মিনিট পর আমার মোবাইলে একটি কল আসে। বলে, “ইমন গুলি খাইছে, হাসপাতালে আসেন।” দ্রুত জেলা হাসপাতালে যাই। সেখানে দেখি শত শত গুলিবিদ্ধ কিশোর-তরুণ। কিন্তু ছেলেরে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই নম্বরে আবার কল দিই, নরসিংদী সদর হাসপাতালে যেতে বলে। গিয়ে দেখি স্ট্রেচারের ওপর বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ছেলের লাশ। তখনই ছেলের লাশ নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। তার মোবাইলটাও পাইনি। পাইলে জানতে পারতাম, ছেলেকে কল দিয়ে কে ডাইকা নিছিল।’
কাইয়ুম মিয়া ভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘থানায় গিয়ে মামলা করার জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বার অনেকেই বলেছিল। আমরা কোনো ঝামেলায় যেতে চাই নাই। বলছি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা কইরা কি বিচার পামু? এমনিতেই ছেলের বুকটা ঝাঁঝরা কইরা দিছে, তার লাশে আর কোনো কাটাছেঁড়া করার দরকার নাই, তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহর জিনিস আল্লায় নিয়ে গেছে, বিচারও আল্লাহই করব।’