দেড় মাস পর মহিষের আসল মালিকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের ২৮৪টি মহিষের মালিক আসলে কে?

- আপডেট সময় : ০৯:৩৪:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫ ৯ বার পড়া হয়েছে
সন্দ্বীপের কালীরচরে এক সকালে মাঠজুড়ে হাজির হয় ২৮৪টি মহিষ। কোথা থেকে এল, কে আনল—তা ঘিরে দ্বীপজুড়ে ছড়ায় কৌতূহল। দাবি উঠেছে রাজনৈতিক দুই পক্ষের। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এই মহিষ নিয়ে তদন্তে নেমেছে উপজেলা প্রশাসন, গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের কমিটি।
৪ জুলাই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের কালীরচরে ঘটে এ ঘটনা। ওই দিন বেলা গড়াতেই মহিষের এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। কারা এসব মহিষের মালিক—এ নিয়ে কৌতূহল দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মহিষের মালিক কে, তা নির্ধারণ করতে তিন সদস্যের কমিটি করতে হয়েছে উপজেলা প্রশাসনকে। বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মহিষগুলো রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মহিষগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।
সন্দ্বীপে মহিষ আনার খবর শুনে নোয়াখালী, হাতিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলা ও সন্দ্বীপের বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন আসতে থাকেন। তাঁদের অনেকেরই মহিষ হারিয়েছে অথবা চুরি হয়েছে। এ নিয়েই মূলত বিপত্তি তৈরি হয়। তবে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ দাবি করেন, এসব মহিষ পলাতক কোনো আওয়ামী লীগ নেতার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব মহিষ এসেছে সন্দ্বীপের দ্বীপ ইউনিয়ন উড়িরচর থেকে। মহিষগুলোর মালিকানা দাবি করেছেন উড়িরচর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ওই ইউনিয়নের বিএনপি সভাপতি আবদুর রহিম ও তাঁর বোনের পরিবার। তবে তাঁদের এই দাবির পরেও বিতর্ক থামেনি। মহিষগুলো বর্তমানে রাখা হয়েছে সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান তাছলিমা বেগমের জিম্মায়।
মহিষ নিয়ে বিএনপির মধ্যে কোন্দল
মহিষের মালিকানা দাবি করা আবদুর রহিম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেনের অনুসারী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। মহিষগুলো সন্দ্বীপে আনার কাজে সহায়তা করেন আজিজ নামের এক যুবদল নেতা। তিনিও বেলায়েত হোসেনের অনুসারী বলে এলাকায় পরিচিত। এ অবস্থায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকেই একটি পক্ষ মহিষের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পুরো বিষয়টিকে জটিল করেছে বলে দাবি আবদুর রহিমের ছেলে মো. আজিমের। ২৮৪টি মহিষের টিকা দেওয়ার কার্ড তাঁরা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজমকে দিয়েছেন। এরপরও বিষয়টি অহেতুক জটিল করা হচ্ছে বলে মো. আজিম দাবি করেন।
যেভাবে এসেছে মহিষ
মহিষগুলো কবে, কীভাবে, কোথা থেকে আনা হয়েছে, তা নিয়ে স্থানীয় অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে । তাঁরা জানান, ৩ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে উড়িরচরের পূর্ব উপকূলের একটি খাল থেকে তিনটি বাল্কহেডে (নৌযান) মহিষ তোলা হয়েছিল। রহিম চেয়ারম্যানের ছেলে আজিম নিজে উপস্থিত থেকে মহিষগুলো তুলেছেন। স্থানীয় বাথানেরাও (মহিষের খামারের মালিক) বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছেন। বাল্কহেডগুলোর একটির চালক মো. উসমান। তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে উড়িরচর থেকে গবাদিপশু ও অন্যান্য মালামাল পরিবহন করছেন। মহিষগুলো স্থানীয় চেয়ারম্যান আবদুর রহিমের। ওই দিন রাতে সাগরে ভাটা থাকায় ভাসানচরের কাছে আমরা নোঙর করেছিলাম। পরে ভোরে জোয়ার এলে সন্দ্বীপের দক্ষিণাংশের কালীরচরে মহিষগুলো নামিয়ে দিই।’
উসমানের দেওয়া তথ্যমতে, মহিষ সন্দ্বীপে নামানোর সময় মো. রিয়াদ ও মো. হেলাল নামের দুজন সঙ্গে ছিলেন। এ দুজন সম্পর্কে আবদুর রহিমের ভাগনে। তাঁরাই মহিষের দেখাশোনার কাজ করেন। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘চাষের মৌসুম শুরু হওয়ায় উড়িরচরে মহিষ চরানোর জায়গা কমে গেছে। তাই সন্দ্বীপে চারণভূমি ব্যবহার করছি। আশ্বিন মাসে আবার মহিষগুলো উড়িরচরে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’
মালিকানার কাগজ তলব
এদিকে মহিষের মালিক কে, এটি নির্ধারণ করতে চলতি মাসের ৯ জুলাই তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে উপজেলা প্রশাসন। এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজমকে। ১২ জুলাইয়ের মধ্যে মালিকানা নির্ধারণ করতে কমিটিকে বলা হয়েছিল। এ কমিটির কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কমিটি গঠনের পরেই সদস্যরা মহিষের মালিকের কাছে প্রমাণপত্র চেয়েছিলেন। তবে মহিষের মালিকানা প্রমাণ কীভাবে হবে, মহিষের দলিল কোথায় মিলবে, এ নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন অনেকেই। কারণ, মহিষ চেনা হয় কাটা দাগ বা শিংয়ের নির্দিষ্ট গঠন দিয়ে। এ ছাড়া মহিষের দাবিদার উড়িরচরের বিএনপি নেতা আবদুর রহিম টিকা কার্ডও জমা দিয়েছেন। এরপরও মালিকানা নির্ধারণ করতে পারেনি কমিটি।
সন্দ্বীপ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা বলেন, ‘মহিষের মালিকানা নির্ধারণে তদন্ত চলছে। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দেড় মাসের বেশি সময় পর চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের কালীরচর থেকে প্রশাসনের জিম্মায় নেওয়া সেই ২৮৪ মহিষের মালিকানা শনাক্ত হয়েছে। এসব মহিষ ১৪ জন ব্যক্তির। তাঁরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উড়িরচরের বাসিন্দা। সেখান থেকে মহিষগুলো বাল্কহেডে (নৌযান) করে কালীরচরে চরাতে নিয়ে আসা হয়েছিল।
দীর্ঘ সময় ধরে তদন্তের পর উপজেলা প্রশাসন এসব বিষয় নিশ্চিত হয়েছে। প্রশাসনের জিম্মায় থাকা মহিষ যাতে মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায় সে লক্ষ্যে গত বৃহস্পতিবার গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের একটি উপকমিটি। এই উপকমিটি আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে প্রকৃত মালিকদের কাছে মহিষগুলো হস্তান্তর করবে। কমিটি গঠনের বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মংচিংনু মারমা নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত ৪ জুলাই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের কালীরচরে এসব মহিষ দেখতে পান স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই দিন বেলা গড়াতেই মহিষগুলোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। কারা এসব মহিষের মালিক—এ নিয়ে কৌতূহল দেখা দেয় দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে। ছড়াতে শুরু করে নানা গুজবও।
এ পরিস্থিতিতে ৯ জুলাই এসব মহিষের মালিক কে, তা নির্ধারণ করতে তিন সদস্যের কমিটি করে উপজেলা প্রশাসন। এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলী আজমকে। কমিটি মহিষের প্রকৃত মালিকদের কাছে মালিকানা–সংক্রান্ত কাগজপত্র তলব করেছে।
বৃহস্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত দুটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে তদন্ত কমিটি ১৪ ব্যক্তিকে মালিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুষ্ঠুভাবে মহিষ হস্তান্তরের জন্য গঠিত হয়েছে তিন সদস্যের উপকমিটি। কমিটির আহ্বায়ক সন্দ্বীপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম সফিকুল আলম চৌধুরী। নৌবাহিনীর স্থানীয় কন্টিনজেন্ট কমান্ডারের একজন প্রতিনিধি ও উপজেলা আনসার-ভিডিপি কর্মকর্তা স্বপন কুমার পাল সদস্য হিসেবে রয়েছেন। মালিকদের উপকমিটির তিন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
মহিষের মালিকদের একজন আবদুর রহিম। তিনি বলেন, অন্য মালিকদের মধ্যে চারজন রাখাল, অন্যরা তাঁর স্বজন ও প্রতিবেশী। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা একই বাথানে মহিষ লালনপালন করে আসছেন। তাঁরা একসঙ্গে মহিষগুলো কালীরচরে চরাতে নিয়ে এসেছিলেন। আরেক মালিক মো. রিয়াদ য বলেন, ‘আমরা টিকা কার্ড ও মহিষের দাগ-বর্ণের লিখিত বিবরণ জমা দিয়েছি। এর বাইরে আর কোনো কাগজপত্র থাকে না মহিষের।’
ইউএনও মংচিংনু মারমা বলেন, ভবিষ্যতে সন্দ্বীপের কোনো চারণভূমিতে পশু স্থানান্তর করলে অবশ্যই প্রশাসনকে আগে থেকে জানাতে হবে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।