চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা: প্রদীপের সংসার অন্ধকারে।

- আপডেট সময় : ০৫:২৮:৩৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ৬ বার পড়া হয়েছে
একসময় পাড়া-মহল্লায় পরিচিত মুখ ছিলেন প্রদীপ লাল দাস। জুতা সেলাইয়ের কাজ করে পাঁচজনের সংসার চালাতেন তিনি। টেনেটুনে জীবন চললেও চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এক ফোঁড়া তাঁর জীবনে নামিয়ে আনে বিপর্যয়। সংক্রমণ থেকে শেষমেশ হারাতে হয় একটি পা। পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা পরিবারকে নাজেহাল করে দেয়।
তবু হাল ছাড়েননি প্রদীপ। মানুষের সহায়তায় ও চাঁদা তুলে একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান কিনে সংসার টেনে নেওয়া শুরু করেছিলেন। মুচির কাজ ছেড়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনেছিলেন—ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনায়।
গত ৯ আগস্ট রাতে নিজের ভ্যান নিয়ে শ্বশুরবাড়ির পথে রওনা হয়েছিলেন প্রদীপ। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বটতলায় স্থানীয় লোকজন তাঁকে চোর সন্দেহে ধরে পিটিয়ে হত্যা করে। তাঁর সঙ্গে প্রাণ হারান মামাশ্বশুর রূপলাল দাসও। মুহূর্তেই প্রদীপের সংসার অন্ধকারে ডুবে যায়।
প্রদীপের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ছড়ান বালুয়া খামার মকিমপুর গ্রামে। তাঁর স্ত্রী দুলালী রানী বলেন, ‘এক পাও দিয়া ভ্যান চালাইত, সেই কামাই দিয়া সংসার চলতো। মোর স্বামী ভালো মানুষ আছিল। ওরে মিথ্যা চোর সাজায়ে মারি ফেলল। এখন স্বামী ছাড়া সংসার টানতে কষ্টে মরছি।’
প্রদীপের বড় ছেলে দুলাল দাস ২০২২ সালে এসএসসি পাস করলেও অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। সংসারের হাল ধরতে দিনমজুরির কাজে নেমেছেন তিনি। ছোট ছেলে আপন দাস সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। দুলাল বলেন, ‘বাবা ছিল, কোনো চিন্তা ছিল না। এখন ভাতের চিন্তায় কাজ করি। বাবার ভ্যানটা থানায়, সেটা পেলেও কিছু করা যেত।’
মেয়ে পলাশী রানী কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘আমার বাবাকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের খাবারের টাকাই জোটে না, পড়াশোনা কীভাবে করব? আমার পড়া হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে, তবে ছোট ভাইটা যেন পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।’
গ্রামের প্রতিবেশীরা জানান, প্রদীপ শত কষ্টেও সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন পরিবার দিশাহারা। ভাঙাচোরা টিনের দুটি ঘরেই চলছে তাঁদের বসবাস।
মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান জানান, পরিবারটিকে ৩০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রদীপের স্ত্রীকে বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করা হবে এবং সন্তানদের জন্য সমাজসেবা থেকে বৃত্তি দেওয়া হবে।
এ ঘটনায় তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক বলেন, ব্যাটারিচালিত ভ্যানটি মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।
পুলিশ জানায়, ৯ আগস্ট রাতে প্রদীপ লাল রবিদাস (৪৭) ও তাঁর মামাশ্বশুর রূপলাল রবিদাস (৪৮) ভ্যানে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলায় স্থানীয়রা তাঁদের চোর সন্দেহে আটক করে। কিছু সময়ের মধ্যেই ‘মব’ তৈরি হয়ে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী মামলা করেন। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।