আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় হেলিপকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার স্থান থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় অনুসন্ধান অভিযানও শেষ হয়েছে। আজ সোমবার (২০ মে) কয়েক ঘণ্টা তল্লাশি চালানোর পর তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। এই ঘটনায় ওই অঞ্চলজুড়ে চলছে শোকের মাতম।
দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, সোমবার ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান ও অন্য কর্মকর্তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি শনাক্ত করেছেন উদ্ধারকারীরা। তবে এ হেলিকপ্টারের যাত্রীদের জীবিত থাকার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান পীর হোসেইন কোলিভান্দ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে বলেন, সোমবার সূর্য ওঠার পর উদ্ধারকারীরা প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে হেলিকপ্টারটি দেখতে পান। তবে এর বেশি কিছু তিনি বলতে পারেননি। তাৎক্ষণিকভাবে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কোনো কারণও জানা যায়নি।
এর আগে রোববার ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের বহনকারী একটি হেলিকপ্টার দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এরপর ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ ছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন। এরপর সোমবার সকালে একটি ড্রোন ফুটেজে দেখা যায়, হেলিকপ্টারটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপরই উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে ভ্রমণ করছিলেন রাইসি। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী শহর জোলফার কাছে বিমানটি বিধস্ত হয়েছে। পরে বলা হয়, এটি উজি গ্রামের কাছে আরো পূর্ব দিকে।
রাইসির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নরসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও দেহরক্ষীরা ছিলেন।
সোমবার সকালে, তুর্কি কর্তৃপক্ষ একটি ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করেছিলো। এতে বলা হয়েছে, জঙ্গলে আগুন দেখা গেছে। আর এটি ‘হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ বলে সন্দেহ করছে’। ফুটেজে দেখা গেছে, আজারবাইজান-ইরান সীমান্তের প্রায় ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) দক্ষিণে একটি খাড়া পাহাড়ের পাশে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিলো।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত মন্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ ভাহিদি বলেন, প্রেসিডেন্ট ও তার সঙ্গীরা কয়েকটি হেলিকপ্টারে করে ফিরছিলেন কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও কুয়াশার কারণে একটি হেলিকপ্টার জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়।
দুর্ঘটনার পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছিলেন, যাই হোক না কেনো ইরান সরকারের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। প্রেসিডেন্ট মারা গেলে ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, খামেনির সম্মতিক্রমে ভাইস ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজন করা হবে।
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, রাইসির অনুপস্থিতিতে দেশটির ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার এরই মধ্যে দেশটির কর্মকর্তা ও বিদেশি সরকারের কাছ থেকে ফোন পেয়েছেন।
৬৩ বছর বয়সী কট্টরপন্থী রাইসি এর আগে দেশের বিচার বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাকে খামেনির একজন অনুসারী হিসেবে দেখা হয়। কিছু বিশ্লেষক মনে করতেন, খামেনির মৃত্যু বা অবসর গ্রহণের পরে ৮৫ বছর বয়সী এ নেতার স্থলাভিষিক্ত হতেন রাইসি।
রোববার ভোরে আজারবাইজান সীমান্তে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন রাইসি। আরাস নদীর ওপর দু-দেশের নির্মিত তৃতীয় বাঁধ এটি। ২০২৩ সালে তেহরানে আজারবাইজান দূতাবাসে বন্দুক হামলা ও ইসরায়েলের সঙ্গে আজারবাইজানের কূটনৈতিক সম্পর্কসহ দুই দেশের মধ্যে শীতল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও এই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যাকে ইরানের শিয়া মতাদর্শের অনুসারীরা এই অঞ্চলে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে।
ইরানের ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাইসি জয়ী হন, যে ভোটে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছিলো। ১৯৮৮ সালে রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দির মৃত্যুদণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে রাইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
রাইসির অধীনে ইরান এখন প্রায় উইপন-গ্রেড স্তরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের ক্ষেত্রে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এদিকে দেশটিতে গণবিক্ষোভ চলছে বছরের পর বছর ধরে। ২০২২ সালে মাহসা আমিনি নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। যাকে হিজাব না পরার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। বিক্ষোভের পর মাসব্যাপী নিরাপত্তা অভিযানে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত এবং ২২ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করা হয়।
গত মার্চে জাতিসংঘের একটি তদন্ত প্যানেল জানায়, আমিনির মৃত্যু ও শারীরিক নির্যাতনের জন্য ইরান দায়ী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ইরান দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে তার সহযোগীরা ব্রিফ করেছেন। তবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে যা প্রকাশিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারেননি।