সমাচার ডেস্ক
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম, তুমি রবে নীরবে গানের রচিয়েতা ও বাঙালির আত্মিক মুক্তি, সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের নায়ক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী আজ বুধবার (৮ মে)। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি বাঙালির মনে ও মননে সব সময় জাগরূক। এদিকে বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ মানে পঁচিশে বৈশাখের আনন্দ উৎসব, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি কিংবা বোলপুরের বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতন বা শিলাইদহ কুঠির বাড়ি কোথায় নাই রবী বাবু। রবীন্দ্রনাথের সাথে আমাদের পরিচয় সেই শিশুকাল থেকে। যেই ক্লাসই হোক, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া যেন চলেই না। ছোটকালে ছড়া, বা গল্প; অথবা তরুনকালে প্রেমের কবিতা, উপন্যাস, ভার্সিটিতে গানের আড্ডা, অথবা চা এর পেয়ালা হাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে সকালটা শুরু, সব জায়গা জুড়েই আছে রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত মানে শুধু কিছু কথা, শব্দ বা ছন্দ নয়! বরং পুরনো কিছু স্মৃতি, প্রিয় কিছু মুখ আর ভালোলাগা সেই মুহূর্তগুলো।
১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ছোট একটি শিশু। সন্ধ্যায় মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে বসলে রবীন্দ্রনাথের প্রথমে হাই উঠত, তারপর আসত ঘুম, তারপর চলত চোখ-রগড়ানি। মাস্টারমশায় বারবার তার অন্য ছাত্রের প্রশংসা করে বলতেন যে, সে ছাত্রটি ছিলো সোনার টুকরো, পড়ায় তার আশ্চর্য মন, ঘুম পেলে চোখে নস্যি ঘষে। আর রবীন্দ্রনাথ? সব ছেলের মধ্যে একেবারে মূর্খ। কিন্তু এতসব বলেও তার ঘুম আটকে রাখা যেতো না। ছোট কালের দুরন্ত এই শিশুটাই বড় হয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন বাঙালির হৃদয়ে।
তিনি ছিলেন বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে পিতা দেবেন্দ্রনাথের ছিলো দেশভ্রমণের নেশা। বছরের অধিকাংশ সময় তিনি কাটাতেন বাড়ির বাইরেই। তাই ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিলো এক “ভৃত্যরাজক তন্ত্রে”।
শৈশবে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বিদ্যালয়ের এই বাঁধাধরা শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর কখনো ভাল লাগেনি। তাই বেশির ভাগ সময়ই স্কুলে যাওয়ার বদলে বালক রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে অথবা বোলপুর, পানিহাটি প্রভৃতি স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করতেন।
ফলে, স্কুলের পাঠ যখন হলো না, তখন বাড়িতে ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিভিন্ন বিষয় পড়া শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা সাহিত্য, চিত্রকলা, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, অঙ্ক-এসব বিষয়ে বাড়িতেই চলতে থাকল তাঁর লেখাপড়া। এরপর তাঁর জন্য রেখে দেয়া হলো গৃহশিক্ষক। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১১ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভ্রমণে। মূলত এই ভ্রমণ তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিলো।
বাবার আদেশে ১৮৯১ সাল থেকে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে রচনা করেন অসংখ্য কবিতা ও গান। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। তারপর শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর কবিগুরু সেখানেই বসবাস করেন। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীনিকেতন’ নামে সংস্থা। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বিশ্বভারতী’।
রবীন্দ্রনাথ একাধারে ছিলেন কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
কর্মসূচি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার পতিসরে, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর এবং খুলনার দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে।
কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বেলা ১১টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্বকবির ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার উদ্বোধন করবেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে ছায়ানটের রবীন্দ্র-উৎসব ২৫ ও ২৬ বৈশাখ (৮ ও ৯ মে) ছায়ানট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে সন্ধ্যা ৭টায়। দুই দিনব্যাপী এই উৎসবে পরিবেশিত হবে একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন। ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত এই উৎসব সকলের জন্য উন্মুক্ত। অনুষ্ঠানটি ছায়ানটের ফেইসবুক পেজে (facebook.com/chhayanaut1961) সরাসরি অনলাইনে দেখা যাবে।